ইসলাম, বিজ্ঞান ও ভ্রান্ত ধারণা
বিজ্ঞান যা মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন বা সহজ করেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের চলার পথে প্রতিটি কাজে কমবেশি জেনে বুঝে বা না জেনে না বুঝে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করি।
বিজ্ঞান নিয়ে অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যেমন অনেকে মনে করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল, কারণ বিজ্ঞান কোরআনের একটি অংশ। কোরআন হলো পুর্নাঙ্গ জীবন বিধান এবং পথ প্রদর্শক। কিছু মুসলমানের ধারণা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিকতা মানুষের ইমান নষ্ট করে মানুষকে কাফির বা নাস্তিকে পরিণত করে।
এই ভুল ধারনা থেকে আমরা মুসলমানরা বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, ফলে আমরা বিধর্মীদের থেকে পিছিয়ে পরছি এবং তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। তারা সহযোগীতার নামে অথবা সহযোগীতা করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে এবং আমাদের বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
বিজ্ঞান এবং কোরআনের জ্ঞান কখনোইে একে অপরের সাংঘর্ষিক নয়। বিজ্ঞান চর্চা এবং তার সঠিক ব্যাবহার মানুষের কল্যাণ এবং ইসলামের আলো প্রতিটি স্থানের কোনায় কোনায় দ্রুত ছড়িযে দিতে পারে। মুসলমানদের ভুল ধারনা এবং অবহেলার কারনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন ইযাহুদী খ্রিষ্টানদের হাতে। তাই বিজ্ঞানের ব্যাবহার এখন বিপরীতে।
আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা এবং বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় মুসলমান বিজ্ঞানীদের ভুমিকা এবং গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেমনঃ রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস সর্বত্র ছিল তাদের অগ্রণী পদচারণা। বহু মুসলিম বিজ্ঞানী দিগন্ত উন্মোচনকারী আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। সেসব আবিষ্কার ও গবেষণার আধুনিকরণ ঘটেছে, তার সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী।
ক্যামেরা: প্রাচীন গ্রীকরা মনে করতো যে, আমাদের চোখে লেজার রশ্মির মতো আলোকরেখা রয়েছে। যা আমাদের দেখতে সাহায্য করে। দশম শতাব্দীতে মুসলিম গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইতাম সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন যে, চোখ থেকে যতোটা আলো বেরোয় তার চেয়ে বেশি আলো চোখে প্রবেশ করে। আলো উইন্ডো শাটারের মাধ্যমে একটি বিন্দুতে প্রবেশ করতে পারে, এটি বুঝতে পারার পর তিনি প্রথম পিনহোল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। আল-হাইতাম বুঝতে পারেন যে, বিন্দু যতো ছোট হবে ছবি ততো ভালো হবে। এ উপলব্ধি থেকে তিনি প্রথম অবসকিউরা (ডার্করুম) স্থাপন করেন। একটি পরীক্ষণের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যার দার্শনিক রূপ তুলে ধরার জন্য তিনি বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী।
রসায়ন শাস্ত্র: ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইসলামের সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ডিস্টিলেশন অর্থাৎ সিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল পদার্থের একটিকে আরেকটি থেকে পৃথক করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। জাবিরই অনেক মৌলিক প্রক্রিয়া ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে আলকেমিকে কেমিস্ট্রি বা রসায়ন শাস্ত্রে রূপ দেন। তার আবিষ্কৃত তরলীকরণ, স্ফটিকীকরণ, সিদ্ধকরণ, শুদ্ধকরণ, অক্সিজেনের সাথে যুক্তকরণ, বাষ্পীভবন ও ফিল্টারেশন প্রক্রিয়া এখনো বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করা হয়। সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড আবিষ্কারের পাশাপাশি তিনি চোলাইযন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র তৈরি হচ্ছে গাঢ় গোলাপ জল, বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্যাদি ও অ্যালকোহল (যদিও ইসলাম ধর্মে এটি হারাম)। জাবির ইবনে হাইয়ান সঠিক প্রক্রিয়া অনুসারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতেন। রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
রকেট: বারুদ তৈরিতে ব্যবহৃত নোনতা গানপাউডার চীনারা আবিষ্কার করে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু আরবরা সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য গানপাউডার বিশুদ্ধকরণের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিল। ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমদের আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্র প্রতিপক্ষ শিবিরে ভীতির সঞ্চার করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলিমরা রকেট (যাকে তারা বলতো স্বয়ংক্রিয় দাহ্য ডিম) এবং টর্পেডো (নাশপাতি সদৃশ সম্মুখে অগ্রসরমান বোমা, যার অগ্রভাগ ছিল বর্শার মতো) আবিষ্কার করে। টর্পেডো শত্রুজাহাজকে ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যেতো।
চিকিৎসা সরঞ্জাম: আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অপারেশন করার জন্য যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলোই দশম শতাব্দীতে মুসলিম শল্যবিদ আল-জাওয়াহিরির উদ্ভাবিত দ্রব্যাদির মতো। তার উদ্ভাবিত হালকা ছুরি, অস্থি কাটার ছুরি, ছোট সাঁড়াশি, চোখের অপারেশনে ব্যবহৃত সূক্ষ্ম কাঁচিসহ ২০০ প্রকার শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি আধুনিক যুগের যে কোন শল্যবিদের অতি পরিচিত জিনিস। তিনিই প্রাকৃতিকভাবে অদৃশ্য হয়, এমন সুতা আবিষ্কার করেন। যা অপারেশনের পর সেলাইয়ের জন্য সার্জনরা ব্যবহার করে থাকেন। ক্যাপসুল তৈরির জন্যও এর ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া উইলিয়াম হার্ভে রক্ত পরিসঞ্চালন পদ্ধতি আবিষ্কারের ৩০০ বছর আগেই ইবনে নাফিস নামে এক মুসলিম মেডিকেল ছাত্র এ প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, আফিম ও অ্যালকোহলের মিশ্রণের মাধ্যমে যে চেতনানাশক ব্যবহার করা হয়, তা-ও আবিষ্কার করেন মুসলিম চিকিৎসকরা। তারা নীডলেরও উন্নতি সাধন করেন, যা ছোখের ছানি অপসারণে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়াও মুসলমানদের আরো অনেক বিষ্ময়কর আবিষ্কার রয়েছে যা আমাদের জীবনকে করেছেন সহজ আনন্দময় যা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি। বা যার প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমরা তার কল্যাণ বা সুফল এখনো ভোগ করে যাচ্ছি।