মনোয়ার আলী মনু-পর্দার আড়ালের এক মহানায়কের গল্প
বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম! কথাটা শুনলেই বুকের মাঝে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি তৈরি হয়! তাই না? গ্যলারী ভর্তি দর্শক, সবার মুখে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ প্রতিধ্বনি! যেন ১৮ কোটি বাঙালির ক্রিকেটীয় আবেগ-ভালোবাসার পরশ, ওরা ১১জন মিলে ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো বিশ্বদরবারে।
হ্যা, পুরো বিশ্ব এখন আমাদের ক্রিকেট টিম কে চেনে, জানে ক্রিকেটের প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসার যায়গা কতটা বড়! এটাও যানে যে আমাদের ক্রিকেটার রা কতটা পরীশ্রম করে আজ এই যায়গাতে পৌছেছে!!
তবে, প্রতিট মুদ্রার ই তো দুইটা পিঠ থাকে, বাংলাদেশ ক্রিকেটর এ-পিঠের কথা পুরো বিশ্বদরবার জানলেও, ও-পিঠের কথা কয়জন ই-বা জানে??
হ্যা, আজকে আপনাদেরকে শোনাবো মুদ্রার ও-পিঠের একজন ক্রিকেটীয় মহানায়কের কথা, যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে পর্দার আড়ালে থেকেই নিজের সবটুকু ভালোবাসা, সু-শ্বাসন, সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন- মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী মিরাজ, আল-আমীন, নুরুল হাসান সোহান, মেহেদী হাসান সহ অসংখ্য প্রতিভাবান ক্রিকেটারদেরকে। হ্যা আজকে আপনাদেরকে শোনাবো এমনই একজন মানুষের গল্প, যিনি খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট কে নিজে আড়ালে থেকেই এমন এক যায়গায় পৌছে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে- খুলনার ক্রিকেটারদের ছাড়া কোনোভাবেই কল্পনা করা সম্ভব নয়।
এতক্ষন আপনাদেরকে শোনাচ্ছিলাম, খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট কোচ এবং খুলনার সর্বোজয়ী ক্রিকেট কোচিং ক্লাব, ক্লাসিক ক্রিকেট ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা, এস এম মনোয়ার আলী মনুর কথা, যাকে ভালোবেসে সব স্টুডেন্ট মনু স্যার নামেই ডাকে। সদা শান্ত-হাস্যোজ্জ্বল এই যাদুকীয় ক্রিকেট কারীগরের জন্ম ২৬ জুলাই, ১৯৬৯ সালে, খুলনা শহরে।
খুলনার সাধারন এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মনোয়ার আলী মনুর ক্রিকেটে যাত্রা শুরু আশীর দশকে অর্থাৎ ১৯৮২ সালে। তার আগে তিনি ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খুলনার ফুটবল দলে খেলতেন। তখন আাসলে ক্রিকেট এতোটা জনপ্রিয় ছিলোনা। মায়ের পছন্দেই মূলত তার ক্রিকেটে আসা। ক্রিকেট শুরু করার পর থেকেই অত্যন্ত সদালাপী ও মিশুক এই ক্রিকেটীয় নায়কের সম্পুর্ন ধ্যান-জ্ঞানের যায়গাতে পরিনত হয় ক্রিকেট, একমাত্র সপ্ন ছিলো নিজেকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেখার,কিন্তুু পরিবার ও পরিস্থিতির কারণে ঢাকাতে অবস্থান করতে পারেন নি, যার কারণে খুলনাতেই ক্যারিয়ার থমকে যায়। খুলনা ব্রাদার্স ক্লাবের হয়ে খুলনা লিগে খেলতেন নিয়মিত।
খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি ছিলেন একজন অলরাউন্ডার। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে পেস বোলার ছিলেন সাথে চার/পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করতেন। পরে ইনজুরির কারণে অফ স্পিন বোলিং শুরু করেন। এছাড়াও মনোয়ার আলী মনু ভালো ফুটবলও খেলতেন। কিন্তু হঠাৎ ভয়ানক এক ইঞ্জুরির কারনে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার থমকে যায়, কিন্তুু যার সব ধ্যান-জ্ঞান ই ক্রিকেট নিয়ে, তিনি কি ক্রিকেট ছাড়া থাকতে পারেন? ইঞ্জুরি থেকে একটু রিকোভার হওয়ার পরেই মনোয়ার আলী মনুর জীবনে নতুন এক ক্রিকেটীয় অধ্যায়ের সুচনা হয়,বাড়ির পাশে একটি স্কুল ছিলো যার নাম “এইচ আর এইচ প্রিন্স আগা খান স্কুল”, সেখানেই প্রথম ক্রিকেট কোচিং করানো শুরু করেন, আর তারপরই তিনি ধীরে ধীরে কোচ হিসাবে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে থাকেন।
মনোয়ার আলী মনু, সফলতার খোজে সবথেকে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার মা 'আনোয়ারা বেগম' এর কাছ থেকে। নিজ পরিবারের মেলবন্ধন-ভালোবাসা তাকে জীবনের সৌন্দর্য দেখিয়েছে, সাথে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সর্বোপরি সবার সমর্থন ই তার মনে সর্বদা শক্তি যোগায় সর্ব পরিস্থিতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি সাধন করে যাওয়ার!
তার জীবনের সবথেকে কাছের বন্ধু, খুলনার প্রয়াত কোচ শেখ সালাহউদ্দিন ছিলেন তার অনুপ্রেরণার আর এক বড় উৎস, প্রীয় বন্ধুকে হারানোর পরে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন তিনি, তবে প্রয়াত বন্ধুর সাথে মিলে দুজনে ক্রিকেটের প্রতি যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলেন সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষে আবারো আরো শক্তিশালী ভাবে তিনি ফিরে আসেন ক্রিকেটের ময়দানে।
প্রয়াত ইংলিশ কোচ বব উলমার এর কোচিং দর্শন মনোয়ার আলী মনুর খুব ই পছন্দের ছিলো, ঢাকাতে বিসিবির একটি প্রোগ্রামে তিনি কোচ বব উলমারের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, যেটা আজীবন তার মনে গেঁথে থাকবে। তবে তার পছন্দের বাকি সব কোচ ই বাংলাদেশের।
কোচ হিসাবে নিজেও অবশ্য সকল গুনেই গুনাম্বিত তিনি, স্কিলে যেমনি পারদর্শী, তেমন ই একজন আদর্শ মেন্টর। খেলোয়াড়দেরকে খুব ভালোভাবে রিড করার এক অসামান্য দক্ষতা আছে এই অসাধারন মানুষটার মাঝে!
ক্রিকেটকেই নিজের জীবন বানিয়ে নেওয়া পর্দার আড়ালের এই মহানায়কের হাত ধরেই খুলনার ক্রিকেটীয় প্রতীভারা নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছেন দূর থেকে দুরন্তর পর্যন্ত।
যেমন, বর্তমানের সেরা উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন, ক্লাসিক বয় নুরুল হাসান সোহানের কথা ই বলা যাক, ক্লাসিক ক্রিকেট ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিকে সে ছিলো একজন পেসার, কিন্তুু মনোয়ার আলী মনু, সোহানের মাঝে দেখেছিলেন একজন আদর্শ উইকেট-কিপার হওয়ার সব গুণাবলী, তাই নিজ হাতেই সোহানকে গড়ে তোলেন দেশের সেরাদের কাতারের একজন উইকেট কিপার হিসাবে!
সোহান যখন ই সময় পায়, যখন ই কোনো সমস্যায় পড়ে,সর্বপ্রথমেই সে তার আদর্শ এবং ক্রিকেটীয় গুরু,মনু স্যারের কাছে ফোন দেয়! ঠিক একারনেই গুরুর সবথেকে প্রিয় শিষ্য নুরুল হাসান সোহান।
কাটার মাস্টার ফিজের পেছনেও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়েছেন বিসিবির এই মাস্টারমাইন্ড কোচ।
মুস্তাফিজুর রহমান যখন প্রথম গুরুর কাছে আসে, তখন নেটে একদম ই ভালো বল করতে পারছিলো না, প্রথম বলটা করেছিলো নেটের বাইরে, কিন্তুু প্রকৃত প্রতিভাকে কিভাবে সবার সামনে তুলে ধরতে হয়, সেটা বেশ ভালো করেই যানেন মনোয়ার আলী মনু। ঐ দিনের পরে টানা ১৩ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজ হাতে মুস্তাফিজুরের স্পট বোলিং এবং কাটার নিয়ে কাজ করেন তিনি, ফলস্বরূপ বাংলার ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটে আর এক রত্নের, দা ফিজ!!
নুরুল হাসান সোহান, মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী মিরাজ, আল আমীন হোসেন, সৌম্য সরকার, শেখ মেহেদী হাসান, অনুর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার অভিষেক দাশ অরন্য সহ খুলনা ও খুলনার বাইরের নবীন বহু ক্রিকেটারদের ক্রিকেট গুরু মনু স্যারের খুলনা বিভাগের পছন্দের প্রবীন শিষ্যদের তালিকায় আছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, জিয়াউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক সহ আরো অনেক ক্রিকেটার। তিনি ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে, জাতীয় দলের ২০জনেরও বেশী ক্রিকেটারের সাথে সরাসরীভাবে কাজ করেছেন!!
একজন পিতা যেমন তার সন্তানকে শাসন ও করতে পারেন আবার বুকে জড়িয়েও নিতে পারেন,খুলনা বিভাগের প্রতিটা ক্রিকেটারের সাথে ঠিক তেমনই সম্পর্ক সবার প্রিয় মনু স্যারের। প্রীয় শিষ্যদের সদা বন্ধু তিনি, গভীর থেকে বুঝতে চেয়েছেন সবার আবেগ-ভালোবাসা। বিপদ-আপদ, ভালো সময়, প্রতিটা মুহুর্তেই নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। খারাপ সময়গুলোতে তার বলা কথাগুলো শিষ্যদের যোগায় অসীম আত্নবিশ্বাস এবং মনোবল!
কয়েকবছর আগে আব্দুর রাজ্জাক ঢাকায় যাওয়ার পথে যখন এক্সিডেন্ট করে, খুলনায় হাসপাতালে আনার পরে রাজ্জাকের পরিবারের সবাইকে মানসিক শক্তি যুগিয়ে তার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত হাসপাতালেই প্রার্থানারত ছিলেন তিনি!!
করোনা মহামারীর মাঝে,যখন ক্রিকেট বন্ধের কারনে, অসংখ্য ক্রিকেট কোচ আর্থিকভাবে সংকটে পড়ে গেছিলো, দুর্দশার সেই দিনগুলোতে মনোয়ার আলী মনু নিজে বিসিবিকে দরখাস্ত লিখেছিলেন, সকল ক্রিকেট কোচদের কে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য!
কোচিং জীবনে শিষ্যদের সুখে, নিজের সুখ খুজে পাওয়া অত্যান্ত সহজ সরল শান্ত এই মানুষটার অবসর সময় কাটে পরিবারের সাথে ভ্রমনে, পুরানো কিছু বন্ধুর সাথে বর্শি দিয়ে মাছ ধরে, আর নিজের শখের কবুতরগুলোর সাথে সময় কাটিয়ে। অবসর সময়ে যেনো আরো একবার সেই ছোটোবেলার রঙিন দিনগুলোকে ফিরে পেতে চান তিনি, ছুটে যেতে চান আঁকাবাকা মেঠোপথ ধরে!
দক্ষ একজন কারিগর তার সবটুকু পরিশ্রম, ভালোবাসা, দক্ষতার সংমিশ্রনে নিজের কোমল হাত দিয়ে অনেক সাধনার পরে গড়ে তোলেন এক একটা নান্দনিক ইমারত, ইমারতটি ঠিক ই সবার প্রশংসাতে ভাসে, তবে এর কারিগর আড়ালেই রয়ে যান।
ঠিক এমনই বাংলাদেশ ক্রিকেটের আড়ালের এক স্বার্থহীন মহানায়ক মনোয়ার আলী মনু, যিনি জাতীয় দলের বহুত মজবুত ইমারতের এক অচেনা কারীগর।
একজন মনোয়ার আলী মনুর অবদান বাংলাদেশ ক্রিকেটে কতটা, সেটা একটা প্রতীবেদন, বা একটা ভিডিওতে কখনোই ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়, তবে আলো-আধারের ক্রিকেটে আরেকজন মনু স্যারকে পেতে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে!
❤️"তিনি আড়াল থেকেই মহৎ,আড়ালেই মহানায়ক"❤️
লেখকঃরায়হান হাসান শুভ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১